স্বদেশ ডেস্ক:
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রকে তার দীর্ঘতম যুদ্ধ থেকে সরিয়ে নিতে চাইছেন, তখন পশ্চিমা মধ্যস্থতাকারীরা ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা জোরদারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার জন্য প্ররোচিত করার চেষ্টা করছে। এ তৎপরতার সাথে সম্পৃক্ত তিনটি বিশ্বস্ত সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
মধ্যস্থতাকারী সূত্রগুলো বলছে, কয়েক মাস ধরে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে গোপনে বার্তা আদান-প্রদান করা হচ্ছে। একই সময়ে দুই পক্ষের মধ্যে বৈরিতার বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা হচ্ছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
‘আফগানিস্তান এমন একটি অঞ্চল যেখানে উভয়েরই স্বার্থ রয়েছে’ এই গোপন যোগাযোগের ব্যাপারে অবহিত একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সের সাংবাদিককে এসব কথা বলেছেন।
হোয়াইট হাউজ এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর মন্তব্যের অনুরোধে কোনো জবাব দেয়নি। ইরানও কোনো বিষয় নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গোপন আলোচনার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে আগ্রহী যে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন ২০ হাজারেরও বেশি বিদেশী সেনার প্রস্থান আফগানিস্তানকে গৃহযুদ্ধের পথে ঠেলে দেবে না, তালেবানের কঠোর ইসলামী শাসন ফিরিয়ে আনবে না এবং আল কায়েদা বা অন্যান্য সুন্নি মুসলিম উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড সেখানে প্রসারিত করবে না।
তারপরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো আফগানিস্তানের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তেহরানও রক্তপাতের পরিমাণ বাড়লে আফগানিস্তান থেকে প্রতিবেশী ইরানে আফগানদের পালিয়ে যাওয়া এড়াতে চাইছে। আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মধ্য এশিয়ার এই দেশটিতে যুদ্ধের কারণে কয়েক দশক ধরে এমনটাই ঘটে চলছে। ট্রাম্প ও তেহরানের আরো একটি অভিন্ন চাওয়া রয়েছে; তা হচ্ছেÑ উভয়ই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার চায়। তবে তেহরান বা ওয়াশিংটন উভয়ই আফগানিস্তানে সহযোগিতা করার জন্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জোট গঠন এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আলোচনার প্রস্তুতির কোনো লক্ষণ নেই।
রয়টার্স দেখেছে ওয়াশিংটনের কাছে প্রেরিত একটি বার্তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আন্তঃআফগান শান্তি আলোচনার বিষয়ে তালেবান নেতাদের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের আলোচনার ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে ইরান।
আফগান-বংশোদ্ভূত প্রবীণ মার্কিন কূটনীতিক জালমে খলিলজাদ তালেবানের সাথে সরাসরি কথা বলে অতি-উদ্যোগী হয়ে শর্টকাট পদ্ধতি নেয়ায় ভুল করেছেন বলে ইরানের এক প্রবীণ কর্মকর্তা বার্তায় বলেছেন। বার্তায় বলা হয়েছে যে, এই পদক্ষেপটি তালেবানের সামরিকভাবে লাভবান করার ফলে তালেবানের ‘রাজনৈতিক আধিপত্য’ দিয়েছে। তালেবান নেতারা ইরানি আলোচকদের বারবার বলে আসছেন যে তারা ‘ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যতীত অন্য কিছু মানবে না।’ শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত ইরান দীর্ঘকাল ধরে সুন্নি মুসলিম তালেবানের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। ১৯৯৮ সালে তালেবান কমপক্ষে আটজন ইরানি কূটনীতিক ও একজন ইরানি সাংবাদিককে হত্যা করেছিল। তালেবানের শাসনামলে ইরান প্রায় যুদ্ধের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।
গোপন যোগাযোগ
জুনে উপসাগরে ইরান একটি মার্কিন ড্রোনকে নামিয়ে দেয়ার পরে তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা সামরিক লড়াইয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। পরে সরাসরি যোগাযোগের ফলশ্রুতিতে ইরানের উপকূলে প্রতিশোধমূলক বিমান হামলা থামিয়ে দিয়েছিলেন ট্রাম্প।
ইরান আলোচনার জন্য উন্মুক্ত, তবে তেহরানের আয়ের প্রধান উৎস শূন্যে নামিয়ে আনতে সাজানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাগুলোর কমপক্ষে স্থগিতাদেশ চায় দেশটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত দু’টি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বার্তাটিতে বলা হয়েছে- ইরানি কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন যে, কাতারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান আলোচনা থেকে বাদ পড়া আফগানিস্তান সরকারকে নিয়ে একটি নতুন শান্তিপ্রক্রিয়া তৈরি করা উচিত, যারা ‘প্রভাবশালী’ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সূত্রগুলো বলেছে, বেশ কয়েকটি গোপন ই-মেইল চালাচালিতে এই আশার আলো দেখা যাচ্ছে যে, আফগানিস্তানে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পারমাণবিক অস্ত্রের বিকাশ রোধে ২০১৫ সালে সম্পন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি তীব্র উত্তেজনা হ্রাস করতে পারে।
এক সূত্র পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা জন বোল্টন ইরানের ওপর দেয়া নিষেধাজ্ঞাগুলো হ্রাসের বিরোধিতা করেছেন এবং তারা আফগানিস্তানের বিষয়ে ইরানের সাথে যেকোনো আলোচনার বিরোধী ছিলেন। তবে তারা বিশ্বাস করেন যে, তেহরান যুক্তরাষ্ট্রের দাবি মেনে নেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
একজন সাবেক আফগান কর্মকর্তা ইঙ্গিত করেছিলেন যে, ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই ইরান তালেবানের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছে। এই সম্পর্ক দেশটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে ঐকমত্য গঠনে সহায়তা করতে পারে।
তালেবান-পরবর্তী আফগানিস্তানের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আলী জালালী বলেছেন, ইরান ‘অত্যন্ত মূল্যবান হতে পারে। এটি ইরানের জন্যও খুব ভালো সুযোগ।’
তেহরান তালেবানের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছে এবং বিদ্রোহীদের কিছু পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছে। পশ্চিমা কর্মকর্তাদের মতে, তারা সীমান্তের নিকটবর্তী মার্কিন সেনাবাহিনীর উপর চাপ বজায় রাখতে তালেবানের সীমিত পরিমাণে অস্ত্রও সরবরাহ করেছে।
পম্পেও ইরানকে তালেবানের ‘সহ-ষড়যন্ত্রকারী’ বলে অভিযোগ করেছেন। তবে কিছু আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞ তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসার ক্ষেত্রে তেহরান চেষ্টা করছে বলে পাল্টা অভিযোগ করেছে। আফগানিস্তানে তালেবানকে ইসলামিক স্টেটের একটি পাল্টা শক্তি হিসাবেও দেখছেন তারা। প্রায় দুই দশক ধরে আফগান সরকারকে সমর্থন দিয়েও তেহরান কাবুলে প্রভাব বিস্তার করেছে।